নিজস্ব প্রতিবেদক: গাজীপুরে অপহরণের মামলা হওয়ার প্রায় চার বছরেও কলেজছাত্র সজীবকে উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। গাজীপুর রয়েল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির একাদশ শ্রেণির ছাত্র সজীব (১৯) বিগত ২০১৯ সালের ২ জুলাই রাতে অপহরণের শিকার হয় মর্মে জিএমপি গাছা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন তার পিতা আব্দুল মালেক। ওই বছরের গত ২৭ জুলাই তিনি মামলাটি (নং-৪৯)দায়ের করেন। অথচ এ মামলা দায়েরের ১৭ দিন আগে ৫ জুলাই সজীবের নিখোঁজ সংক্রান্তে গাছা থানায় সাধারণ ডায়েরি (নং-২১১) করেন।
এদিকে সজীব অপহরণ বা নিখোঁজ সংক্রান্তে সজীবের মা জবেদা বেগম ও বাবা আব্দুল মালেক পরস্পরকে দোষারোপ করছেন এবং তাদের উভয়ের দেয়া তথ্যেও রয়েছে যথেষ্ট গড়মিল। সজীব আব্দুল মালেকের দ্বিতীয় সংসারের সন্তান। এ সংসারে আব্দুল মালেকের ২ ছেলে সজীব ও সাইদুল ইসলাম। জবেদার অভিযোগ, তার দুই ছেলে বিশেষ করে সজীব বরাবরই পিতার পক্ষ থেকে বিমাতাসূলভ আচরণের শিকার হয়ে আসছিল। তিনিও (জবেদা) স্বামী আব্দুল মালেকের দ্বারা বহু বার নির্যাতিত হয়েছেন। তার স্বামী গোশত ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক এলাকায় ‘কসাই মালেক’ নামে সমধিক পরিচিত। হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন অভিযোগে মালেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে। জবেদা বেগমের ভাষ্যমতে, আব্দুল মালেকের সাথে তার দাম্পত্য জীবনের মেয়াদকাল প্রায় ৩২ বছর। বিবাহর পর থেকেই আব্দুল মালেকের বহু নির্যাতন সহ্য করে আসছেন। প্রায় ৩০ বছর আগে আব্দুল মালেক তাকে মারপিট করে বাড়ি থেকে বের করে দেন। সেই থেকে অদ্যবধি তিনি গাছা থানার গুতিয়ারা এলাকায় পিত্রালয়ে অবস্থা করছেন। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিতে বাড়ি করে দুই সন্তানকে নিয়ে বহু কষ্টে জীবন যাপন করছেন। তিনি টঙ্গীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালের আয়া হিসেবে চাকরি করতেন। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত দাত্রি হিসেবেও বাসা-বাড়িতে গিয়ে প্রসূতিদের সেবা দেন। এছাড়াও নারি মৃত দেহের দাফন কাফনের কাজও করেন। সজীব নিখোঁজের বেশ কয়েক দিন আগে একটি লাশের গোসল দিয়ে বাড়ি ফিরেন এবং ঘরে প্রবেশের আগেই গোসলখানায় গিয়ে গোসল সেরে নেন। এসময় তার স্বামী আব্দুল মালেক এসে গোসলখানায় তার ওপর চড়াও হন। তার চিৎকারে ছেলে সজীব দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে এসে তাকে রক্ষা করেন এবং বাবা আব্দুল মালেকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। এঘটনায় সজীবের প্রতি চরম ক্ষুব্দ হন আব্দুল মালেক। ঘটনার কয়েক দিন পর ছেলে সজীবকে মাদক কারবারি সাজিয়ে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করান এবং গাজীপুর সদর থানা এলাকায় খবর দিয়ে নিয়ে মাস্তান লেলিয়ে দেন। মা জবেদা বেগম আরো জানান, ঘটনার দিন বিগত ২০১৯ সালর ২ জুলাই রাতে সজীব নিজের রুমে পড়ার টেবিলে ছিল। ওই দিন রাত ৮টায় আব্দুল মালেকের ভাতিজা সাজিদ এসে সজীবকে ডেকে নিয়ে যায়। এর পর থেকে সজীব নিখোঁজ হয়। খোঁজাখুঁজির তিন দিন পর তিনি জানতে পারেন, ওই দিন রাতেই সজীবকে চাচাতো বোন শিরিনের ঘরে কুপিয়ে হত্যা' করে লাশ' গুম করা হয়েছে। এ ঘটনায় তিনি গাছা থানায় অভিযোগ দিলে পুলিশ তার অভিযোগ আমলে নেয়নি। জবেদা বলেন, ‘থানায় গেলে ওসি ইসমাইল আমাকে দেখলেই তাড়িয়ে দিতেন। ওসি বলতেন, ‘আপনি মহিলা মানুষ একা আসেন কেন ? আপনার স্বামীই তো লোকজন নিয়ে বার বার থানায় আসছেন।’ জবেদা বলেন, ‘অভিযোগে আমার স্বাক্ষর নেয়া হয়। মামলা হওয়ার পর জানতে পারি, আমার অভিযোগ ছিঁড়ে ফেলে আব্দুল মালেককে (সজিবের বাবা) বাদী করে মামলা রুজু করা হয়েছে।’ মামলা হওয়ার পর অপহরণের ঘটনা প্রমাণ করতে বিকাশে মুক্তিপণের টাকা পাঠানোর নাটক সাজানো হয়েছে। জবেদা প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আব্দুল মালেক ছেলেকে উদ্ধারের জন্য বিকাশে ৩৫ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন এবং বিকাশের যে দোকানে ওই টাকা লেনদেন হয়েছে সেই দোকানদারকে চট্রগ্রাম থেকে পুলিশ দিয়ে ধরে গাছা থানায় এনেছেন। তাহলে অপহরণকারীদের গ্রেফতার ও তার ছেলের সন্ধান এখনো উদ্ধার করতে পারেনি কেন পুলিশ ?’ গাছা থানার তৎকালীন ওসি ইসমাইল হোসেন ও মামলাটির প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সজল সজীবের বাবা আব্দুল মালেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ খেয়ে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা ও আলামত নষ্ট করেছেন অভিযোগ করে জবেদা বেগম বলেন, ‘ভাসুরের ছেলে সাজিদ (মালেকের ভাতিজা) আমার ছেলেকে বাসা থেকে ডেকে নেয়ার পর নিখোঁজ হয়। গাছা থানা পুলিশ উক্ত সাজিদকে এবং মুক্তিপণের টাকা লেনদেনের অভিযোগে বিকাশের দোকান মালিককে গ্রেফতার করলেও আব্দুল মালেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে থানা থেকে ছেড়ে দিয়েছে।
তবে সজিবের মা জবেদার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আব্দুল মালেক বলেন, ‘আমার ভাতিজা সাজিদকে পুলিশ সন্দেহজনকভাবে থানায় নিয়েছিলো, জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে সন্দেহ না হওয়ায় ছেড়ে দিয়েছে’। তিনি বলেন, ‘বিকাশে টাকা যারা নিয়েছে সেই অপহরণকারীদের ধরতে চাইলে জবেদাই বাধা দিয়েছে। জবেদাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।’ জবেদাকে নষ্টা ও মানসিক রোগী বলেও আব্দুল মালেক দাবি করেন।
এদিকে এব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গাজীপুর সিআইডি পুলিশের এসআই হাফিজ জানান, তিনি মামলাটির ৪র্থ তদন্তকারী কর্মকর্তা। এর আগে সিআইডির একজন ও গাছা থানার দুই জন অফিসার মামলাটি তদন্ত করেছেন। তারাও কোন ক্লু উদঘাটন করতে পারেননি। অপহরণ ও বিকাশে মুক্তিপণ আদায় হয়ে থাকলে তখন আসামীদের চিহ্নিত করার সুযোগ ছিল। এখন সেসব আলামত নিয়ে তদন্তে এগুতে সমস্যা হচ্ছে। এর পরেও তখনকার সময়ের মোবাইল কললিস্ট চেয়ে মোবাইল ফোন অপারেটরদের কাছে যোগাযোগ করা হয়েছে। এখন আর সেই সময়কার কললিস্ট ও বিকাশ লেনদেনর রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে না।
গাজীপুর জেলা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মাইনুল আফছার বলেন, মামলাটি আমরা অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। সজীবের মা ও বাবাকে সিআইডি অফিসে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সজীবের ভাই সাইদুলকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু সে মুখ খুলছে না। সজীবের মায়ের সন্দেহের তীর আব্দুল মালেকের দিকে। আমরা সব দিক বিবেচনা করেই তদন্তে এগুছি।
এদিকে মামলাটির প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সজল (বর্তমানে টঙ্গী পশ্চিম থানায় কর্মরত) সজীবের মা জবেদার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা রহস্য উদঘাটনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। সজীবের বাবা আব্দুল মালেককে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে বিকাশের দোকান মালিককে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে এসেছি। কিন্তু মুক্তিপণের টাকা তার দোকান থেকে যারা উত্তোলন করেছে তাদেরকে তিনি চিনেন না বিধায় এবং এ ঘটনায় তার কোনো সম্পৃক্ততার প্রমাণ না পাওয়ায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর থানা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। জবেদার সন্দেহের ভিত্তিতে সজীবের চাচাতো ভাই সাজিদকেও আটক করে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু কোনো তথ্য না পাওয়ায় তাকেও থানা থেকেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ রফিকুল ইসলাম
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত