নিজস্ব প্রতিবেদক:বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশন নেতা শহিদুল ইসলামকে প্রকাশে পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। শ্রমিক নেতা শহীদুল হত্যা মামলার তদন্ত থানা থেকে শিল্প পুলিশে ন্যাস্ত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পেয়েই শিল্প পুলিশের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য গ্রহন এবং সিসি ক্যামেরা ফুটেজও সংগ্রহ করেছেন ইতিমধ্যে। অপরদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দুই সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তার স্ত্রী কাজলী বেগম। প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে পোশাক শ্রমিকদের দুটি সংগঠনের নেতৃত্বের বিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী দোকানদার ফারুক, গার্মেন্টশ্রমিক সাব্বির ও পাশের একটি প্রতিষ্ঠানের দারোয়ান আনোয়ার প্রায় অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। তারা জানান, বিবদমান দুটি শ্রমিক সংগঠনের নেতারা কথা কাটাকাটি করে রাস্তা দিয়ে উত্তরে গাছার দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ত্রাণ ও দুর্যোগব্যবস্থাপনার গেটের কাছে শ্রমিক নেতা শহীদুল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়েন। এসময় তার সহকর্মীরা পাশের মাসকোর গেটে গিয়ে দারোয়ানের কাছ থেকে পানি চেয়ে নেন এবং শহীদুলের মাথায় পানি ঢালেন। এক পর্যায়ে তারা শহীদুলকে রিকশায় উঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান। তখন শহীদুল রাস্তায় কোনো মারামারি বা হামলার শিকার হননি বলে এ তিন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। প্রত্যক্ষদর্শীদের এ বক্তব্যের সাথে প্রাপ্ত সিসি টিভি ফুটেজেরও মিল রয়েছে। হাসপাতালে নিহত শহীদুলের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতকালেও কোনো আঘাতের চিহ্ন পায়নি পুলিশ। আঘাতজনিত কারণে শহীদুলের মৃত্যু হওয়ার কোনো কারণ পাননি লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকও। মামলাটির বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২ এর পরিদর্শক মো. ওসমান আলী জানান, চিকিৎসকরা শহীদুলের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের জন্য ভিসেরার নমুনা ঢাকায় ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়েছেন।
তিনি আরো জানান, শিল্প পুলিশ সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি তদন্ত করছে। ইতিমধ্যে মামলার একজন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি আসামীদের গ্রেফতারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ি ইউনিয়নের মিটালু গ্রামে বাস করেন নিহত শহিদুল ইসলামের স্ত্রী ও নাবালক দুই ছেলে। ভিটে ছাড়া আর কোনো জমি নেই তাদের। আয়-উপার্জনেরও নেই কোনো পথ। শহিদুলের বড় তিন ভাইয়ের মধ্যে দুজন একটি কোম্পানিতে স্বল্প বেতনে চাকরি করেন। বড় ভাই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বর্তমান ভাইয়েরাই দেখাশোনা করছেন শহিদুলের স্ত্রী সন্তনানদের। কিন্তু টাকার অভাবে চিকিৎসা থেমে আছে ক্যানসার আক্রান্ত স্ত্রী কাজলী বেগমের।
কাজলী বেগম বলেন, ২০০২ সালে শহিদুলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তখন তারা ঢাকায় মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় বসবাস করতেন। কাজলী বেগমও আগে পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আমার স্বামী। তাকে হারিয়ে অর্থ সংকটে পড়েছি। বড় ছেলে সাদিকুল ইসলাম (১৬) এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে আর ছোট ছেলে ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (৫) প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। তিন মাস ধরে আমি ক্যানসার আক্রান্ত। নিজের টাকায় তিনটি কেমোথেরাপি দিয়েছি। আরও দুটি থেরাপি বাকি আছে। দিতে হবে ২৫টি রেডিও থেরাপিও। এর খরচ বহন করার মতো সমর্থ আমার নেই। এমনকি ছেলেদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার মতো অবস্থাও নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে স্বামী হত্যা বিচার দাবি করছি।
কাজলীর অভিযোগ, স্বামী নিহত হওয়ার পরদিন অনেকেই তার বাড়িতে এসেছিলেন। এরপর থেকে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার ছাড়া কেউ তার খোঁজ নিচ্ছেন না। কল্পনা আক্তার তাকে বিভিন্নভাবে সান্তনা দিচ্ছেন। টঙ্গীতে শ্রমিক নেতা শহিদুল হত্যার ঘটনায় থানা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার। তার অভিযোগ, সংগঠনের জেলা কমিটির সভাপতি শহিদুল ইসলামকে হত্যার পর আমরা যাদের আসামি করতে বলেছিলাম পুলিশ সেই নামগুলো নেয়নি। থানা পুলিশের আন্তরিকতার অভাবে মামলার আসামিও ধরা ছোয়ার বাইরে।
টঙ্গী পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহ আলম বলেন, এ ঘটনায় কারখানার মালিক মো. সাইফুদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সাইফুদ্দিন দাবি করেছেন, তিনি এ হামলার বিষয়ে কিছুই জানেন না। এছাড়া কামরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে ছিলেন না, তিনি কারখানার সঙ্গে যুক্ত নন।
উল্লেখ্য, গত ২৫ জুন গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী সাতাইশ এলাকায় প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেড নামক কারখানায় বকেয়া বেতন আদায় সংক্রান্তে নেতৃত্ব নিয়ে কারখানাটির বাহিরে দুটি শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় প্রতিপক্ষের আঘাতে শ্রমিক নেতা শহীদুলের মৃত্যু হয় মর্মে অভিযোগ করে বাংলাদেশ গার্মেন্টস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন।
এঘটনায় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কল্পনা আক্তার বাদী হয়ে গত ২৬ জুন টঙ্গী পশ্চিম থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের টঙ্গী পশ্চিম থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাজহারুলসহ ৬ জনকে এজাহার নামীয় আসামী করা হয়। আসামীদের ৫ জনই বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের নেতা। নিহত শহীদুল ইসলাম বাংলাদেশ গার্মেন্টস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের গাজীপুর জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন।
শ্রমিকদলের প্রতিবাদ সভা
অপরদিকে গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা শহীদুল ইসলাম হত্যাকান্ডের বিচারের দাবীতে শক্রবার প্রতিবাদ সভা করেছে গাজীপুর জেলা ও মহানগর জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদল। নগরীর রাজবাড়ি সড়কে দলীয় কার্যালয় প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন, বিএনপির কেন্দ্রিয় সহ-শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবীর খান। গাজীপুর জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি মোঃ আক্তারুজ্জামান বাবুলের সভাপতিত্বে, মহানগর শ্রমিক দলের সদস্য সচিব আব্দুল মোমেন ও জেলা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ উদ্দিনের সঞ্চালনায় প্রতিবাদ সমাবেশে আরো বক্তব্য দেন, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আনোয়ার হোসেন,শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মনজুরুল ইসলাম।
Discussion about this post