নিজস্ব প্রতিবেদক: জমজমাট কাঁচা চামড়া কেনাবেচায় পোস্তার আড়ত, মানভেদে দামে হেরফের জমে উঠেছে রাজধানীর পোস্তার চামড়ার বাজার।
ঈদের দিন দুপুরের পর থেকে রাজধানীর লালবাগের পোস্তার আড়তগুলোতে কোরবানির পশুর চামড়া আসতে শুরু করে। এসব চামড়া দরদাম করে বেচাকেনা করছেন ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা। চামড়ার মান ও আকারভেদে দামেও রয়েছে হেরফের। চারশো টাকা থেকে শুরু করে ভালো মানের চামড়া বিক্রি হচ্ছে হাজার টাকা পর্যন্ত। মানভেদে ভালো চামড়া বারোশো টাকায় কিনছেন আড়তদাররা।
এদিন সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি ও মহল্লা ঘুরে দেখা গেছে, চামড়া সংগ্রহ করে পোস্তায় নিয়ে যাচ্ছেন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। আড়তদাররা তাদের কাছ থেকে দুপুরের পর থেকেই চামড়া কেনা শুরু করেছেন। এ কেনাবেচা চলবে আরও বেশ কয়েকদিন।
এদিকে পোস্তায় কাঁচা চামড়া ওঠা শুরু হতেই আড়তদারদের হাঁকডাকে সরগরম হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা। ঈদের দিন বৃহস্পতিবার ২৯ জুন দুপুরের পর লালবাগের শায়েস্তা খান ও রাজনারায়ণ ধর রোডসহ আশপাশের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাক ও পিকআপভ্যানে চামড়া নিয়ে আসছেন ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা। তাদের কাছ থেকে দরদাম কষে চামড়া কিনছেন আড়তদাররা। দুপুরের দিকে বিক্রেতাদের চাপ না থাকলেও শেষ বিকেলে জমজমাট হয়ে ওঠে পোস্তার আড়তগুলো। সন্ধ্যার দিকে আড়তদারদের ব্যস্ততা আরও বাড়ে।
পোস্তার আড়ত মালিক সুমন বলেন, কোরবানি পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় পোস্তায় এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি কাঁচা চামড়ার বেচাকেনা। তবে রাতের দিকে কেনাবেচা আরও জমে উঠতে পারে।
পোস্তার এ চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, চামড়া সংগ্রহে আমরা প্রস্তুত আছি, কিন্তু কোরবানি শেষ না করে তো কেউ চামড়া নিয়ে আসবেন না। আজ গভীর রাত পর্যন্ত চামড়া কেনাবেচা চলবে। আড়তে চামড়া সংগ্রহের পর প্রথমে লবণজাত করা হবে। পরে সেসব চামড়া পাঠানো হবে সাভারের ট্যানারিগুলোতে।
তবে দেশের সবচেয়ে এ বড় কাঁচা চামড়ার বাজারে গত বছরের মতো এবারও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চামড়া সংগ্রহ হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সেখানকার কামাল অ্যান্ড সন্স আড়তের আনোয়ার হোসেন বলেন, ঢাকা শহর ও এর আশেপাশের কোরবানির পশুর চামড়া পোস্তায় আসতে শুরু করেছে। দুপুর থেকেই আমরা কাঁচা চামড়া কেনা শুরু করেছি। বিকেলের দিকে কেনাবেচা জমে উঠেছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া যত তাড়াতাড়ি আমাদের কাছে আনবেন তত ভালো। আমরা আগেও বলেছি, চামড়া কেনার সময় যেন ভেবেচিন্তে কিনেন আড়তদাররা। চামড়ার মান বুঝে আমরা দাম দিচ্ছি।
তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে লবণযুক্ত চামড়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকা প্রতি বর্গফুট হিসেবে ফড়িয়াদের কাছ থেকে কেনা হচ্ছে। এখন যেসব চামড়া আসছে সেগুলো লবণ ছাড়া, সেজন্য এসব চামড়া প্রতি বর্গফুট ৫ থেকে ৭ টাকা কমে কিনতে পারছি।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার কোরবানির পশুর চামড়া সন্ধ্যা ৭টা এবং শহরের বাইরের চামড়া যদি রাত ১০টার মধ্যে পোস্তায় আনা যায়, তাহলে পচন রোধ করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে বিক্রেতারা দামও ভালো পাবেন। যারা এসময়ের মধ্যে চামড়া আড়তে আনতে পারবেন না, তারা যেন লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করেন। নয়তো গরমে চামড়া নষ্ট হতে পারে।
এ ব্যবসায়ী জানান, গত বছর লবণের দাম ছিল ১ হাজার টাকা বস্তা, কিন্তু এবার বস্তাপ্রতি দাম সাড়ে তিনশো টাকা বেশি। অন্যদিকে কাঁচা চামড়াও কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। এমনকি সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি দিতে হচ্ছে।
যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে প্রতি বছর দেশে অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কোরবানির পশুর চামড়া নষ্ট হয়। বর্তমানে গরম অনেক বেশি। এছাড়া জ্যামের কারণে চামড়া নিয়ে আড়তে আসতেও বিক্রেতাদের অনেক সময় লাগে। তবে আড়তদারদের আশা, এ বছর চামড়া সংরক্ষণে ভালো ব্যবস্থাপনা থাকবে। এক্ষেত্রে সরকারও কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে সারাদেশে কম দামে চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। এমনকি ঢাকা শহরেও চামড়ার বেচাকেনা নির্ধারিত দামে হয়নি।
২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, ঢাকার বাইরে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। সারাদেশে খাসির চামড়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। অন্যদিকে গত বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৪৭ থেকে ৫২ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা ছিল। আর খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এ বছর কোরবানির পশুর লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুটে গত বছরের চেয়ে ৩ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। ঢাকার বাইরের চামড়ার দাম বাড়ানো হয়েছে ৫ টাকা। আর খাসি ও বকরির চামড়ার দাম গত বছরের মতোই রাখা হয়েছে। ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, এ বছর ট্যানারি ব্যবসায়ীরা যদি দাম কমানোর জন্য কোনো ফন্দি করে তাহলে আমরা চামড়া বিদেশে রপ্তানির অনুমতি দেবো। আমরা চাই, না সেটা হোক। এ বছরও আমাদের ঘোষণা হলো, কারসাজির মাধ্যমে দাম কম নেওয়া, দেওয়া বা চামড়া না নেওয়ার চেষ্টা করলে আমরা ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমোদন দেবো।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এ চামড়ার ৬০ ভাগের বেশি পাওয়া যায় কোরবানির ঈদ মৌসুমে। এরমধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া।
Discussion about this post